‘পেডং’ না ‘পেদং’- নাম নিয়ে বিভ্রান্তিতে সময় নষ্ট না করে নতুন নাম শোনা ছোট্ট পাহাড়ি জনপদের অজানা রূপে বিভোর হতেই হয়। ঐতিহাসিক আমল থেকেই বণিকদলের আনাগোনায় সমৃদ্ধ হয়েছে যে গ্রাম, তারই আধুনিক অথচ আটপৌরে রূপ দেখে সেম্মাহিত হয়েছেন লেখক। তাঁর কলমে পেদং-এর মনকাড়া ছবি।
কালিম্পং বাস স্ট্যাণ্ডে পৌছতেই কানে এল ‘‘পেদং, পেদং’’ হাক। হ্যা, জায়গার আদত নাম ‘পেডং’ নয়, ‘পেদং’। ভুটিয়া ভাষায় পেদং মানে সুগিন্ধ গাছের জায়গা। সুগিন্ধ, অর্থাৎ ধুপি গাছ। জুনিপার গোত্রের এই গাছ হিমালয়ের এই অঞ্চলে ৪০০০ ফুটের ওপরে দেখা যায়। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই তার গুণ। ধুপি কাঠে কখনও উই বা ঘূণ ধরে না। এর পাতা শুকিয়ে জ্বাললে অপূর্ব সুগন্ধ বের হয়। ধূপের মতো গন্ধ বলেই নাম ধুপি। স্থানীয়দের বিশ্বাসে, অতি পবিত্র এই গাছ আকৃষ্ট করে স্বর্গবাসী দেবতাদেরও।
কালিম্পং থেকে পেদং ২১ কিলোমিটার। কালিম্পংয়ের ঘন বসতি ছাড়াতেই পাহাড় হাট করে খুলে দিল তার অপরূপ অন্দরমহলের দরজা। গ্রীেষ্মর শেষে বর্ষারেম্ভর প্রস্তুতির চিহ্ন আকাশ জুড়ে। মেঘের পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছে ম্লান সূর্য। পাকদিণ্ড পথের এক পাশে গভীর খাদ আর অন্য পাশে শ্যাওলা, ফার্ন আর রকমারি রংবেরঙের অচেনা ফুলে সাজানো পাহাড়ের ধাপ। কখনও পাহাড়ের বাকে কয়েক ঘরের এক ফেঁাটা গ্রাম। টিনের চালওয়ালা কাঠের বাড়ির জানালায় হালকা নেটের পর্দা আর এক চিলতে বারান্দায় ঠাসাঠাসি করা টবে ফুলের মেলা।

শুনলাম, আর একটু চড়াই ভাঙলে দেখা মিলতে পারে নানা রঙের গুরাস-এর, মানে রডোডেনড্রন। ১৫ কিলোমিটার পাকদণ্ডি পথের শেষে ছোট শহর আলগারা। গাড়ি এখানে ১৫ মিনিট থামল। টুক করে নেমে এক চক্কর হেঁটে এলাম। বাজারে বিকোচ্ছে টাটকা ফল আর সবজি। মোষের মাংসের দোকানে বেশ ভিড়। শহুরে হাবভাব এখানে যথেষ্টই, আছে সাইবার কাফে, সি ডি লাইব্রেরি আর বৈদ্যুতিন জিনিসপত্রের দোকান। পেদং এখান থেকে আর ছয় কিলোমিটার। দু’ কিলোমিটার চড়াই ভেঙে গাড়ি উতরাই পথ ধরল। কুড়ি মিনিটেই পৌছলাম ৪৭০০ ফিট উচ্চতার পেদংয়ের বাজার সংলগ্ন ট্যাক্সি আড্ডায়।
২।

স্ট্যাণ্ডের পাশে ফুটবল মাঠ। স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলের দল সেখানে বল পিটছে। মাঠের উেল্টা দিকে বিশাল স্কুলবাড়ির বারান্দায় হুটোপুটি করছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। ক্রিশ্চান মিশনারিদের স্কুল সেন্ট জেভিয়ারের নামে। পাশেই আছে ক্যাথলিক গির্জা। অনেক বছর ধরেই এখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কনভেন্ট। সেন্ট জেভিয়ার্স ছাড়াও আছে সেন্ট জর্জ, গ্রেস স্কুল এবং টেণ্ডার বাড্স, স্প্রিং বণ্ড, সানরাইজ, কিড্স ক্যাস্ল-এর মতো কয়েকটা প্রাইমারি স্কুলও।
৩।

হোটেলের পোশাকি নাম ‘পেদং হলিডে রিসর্ট’ হলেও ‘রাই নিবাস’ নামেই লোকে চেনে। পেদং বাজারের কাছে পাহাড়ের ঢালের ওপর দোতলা বাড়ির চার দিক ঘিরে বাগান। একটু অগোছালো সেই বাগানের রূপ যেন বেশি খুলেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুলের মেলায়। ফলের গাছও আছে। পিচ, চেরি, আলুবোখরা এমনকী ছোট ছোট ষ্ট্রবেরির ঝোপও। গৃহস্বামী সপরিবার ওপরতলায় বাস করেন। একতলার পুরোটা জুড়ে অতিথিশালা। রিসেপশন কাউন্টারে রসিদপত্র বুঝে নিল যে ছেলেটি, তার নাম শ্রাবণ। সম্পর্কে রাই মশাইয়ের ভাইপো। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স নিয়ে এম.এ. পড়ছে। তার সঙ্গী ভিকির পড়াশোনা বারো ক্লাস পর্যন্ত। দু’জনে ভারী দোিস্ত। হোটেলের ম্যানেজার- কাম- রাধুনি- কাম- ওয়েটার ভিকি থাকে বাজারের পাশেই। সে নাকি আঞ্চলিক সিনিয়র ফুটবল টিমের অধিনায়কও! যাই হোক, লাঞ্চে তার রাধা চিকেন কারির স্বাদ যে অমৃতসম তা স্বীকার করতেই হল।
৪।

বিকেলে চললাম মন্যািষ্ট্র দেখতে। এই দিকে সর্বত্র বৌদ্ধ গোম্ফার ছড়াছড়ি। পেদং শহরে আছে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সেনা ছাউনি। তার রাস্তা ধরে উঠতে হয় পাহাড়ের মাথায়, যেখানে কাঠ আর সিমেেন্টর তৈরি প্রাচীন গোম্ফা দাড়িয়ে। ১৮৩২ সালে তৈরি এই সিকিমি গোম্ফার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৮২ সালে লেখা কালিম্পংয়ের তদানীন্তন ডেপুটি কালেক্টর সি. আর. ম্যারিনডিনের পেশ করা রিপোর্টে। বহরে ক্ষুদ্র হলেও গাম্ভীর্যে তুলনাহীন তার উপিস্থতি। অন্যান্য মন্যািষ্ট্রর তুলনায় পেদং গোম্ফার চাকচিক্য কম। এক তলার প্রার্থনাকক্ষের মেঝে আর সিলিং কাঠের, দেওয়াল কংক্রিটের। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম— বিশাল মাপের বুদ্ধমূর্তি এখানে নেই। তার বদলে সারিবদ্ধ কাচের শো-কেসে রাখা তিন ফুটের বিভিন্ন মূর্তি। বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, গুরু পদ্মসম্ভব, অতীশ দীপঙ্কর ও বৌদ্ধ তারাকে চিনতে পারলাম। তাংখার ঝালরে মোড়া থামগুলো। ঘরের দুই পাশে টানা মাদুর পাতা, যার সামনে সার সার জলচৌকির ওপর তিব্বতি হরফে লেখা পুথি, মণিচক্র আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। যেমন শিঙা, মৃদঙ্গ, ঝাঝর, ঢোল। প্রার্থনার সময় লামারা এই সব বাজনার সঙ্গতেই মেন্ত্রাচ্চারণ করেন। গোম্ফার ওপর তলায় ছোট ঘরে তিন ধাপ জুড়ে জ্বলছে মাখনের প্রদীপ। সেখানে বুদ্ধের নানান রূপের ধাতব মূর্তি সাজানো। ধূপের গেন্ধ হাওয়া ভারী হয়ে আছে। ভাব-গাম্ভীর্যে ভরপুর গোম্ফা দেখে আমরা চললাম বাজারের দিকে।
৫।

পেদং বাজারে ঢোকার মুখে ভিকির সঙ্গে দেখা। আমাদের রাতের খাবারের মালমশলা জোগাড় করতেই যে সে এসেছে তা এক কথায় জানাল। মোমোর অমোঘ হাতছানি না এড়াতে পেরে তিব্বতি রেেস্তারায় বসে পড়লাম। মোষের মাংস, স্থানীয় মানুষের ভাষায় ‘বাফ’-এর মোমো। সঙ্গে ধোয়া-ওঠা স্যুপ। আটটা মোমোর েপ্লটের দাম পনেরো টাকা। ছোট বাটিতে আছে টম্যাটো ও ডেল্লর ঝাল-টক আচার। অপূর্ব স্বাদ! নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল প্লেট।
হোটেলে ঢুকতে না ঢুকতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। মুষলধারার ঘোলা পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল সমস্ত চরাচর। কাচের জানলায় মুখ ঠেকিয়ে বাদলধারার তাণ্ডব দেখলাম অনেকক্ষণ। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি আর তীব্র শেব্দ অশনিপাত। তবে আধ ঘন্টা জোরে বৃষ্টি হয়ে আচমকাই থেমে গেল। ঠাণ্ডা বাড়ল জাঁকিয়ে। ঝিঁঝির একটানা ডাক আর ক্ল্যাপিং বিট্লসের কটাকট সঙ্গতে অজােন্তই ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল।
৬।

সকালে চায়ের ট্রে নিয়ে ভিকি যখন ঘুম ভাঙাল ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ছ’টা। জানলার পর্দা সরাতেই ঘরে ঝলমলে রোদ ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্রেকফাস্ট সেরে শ্রাবণের সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম ড্যামস্যাং দুর্গের দিকে। মন্যাষ্ট্রির রাস্তা ডান হাতে রেখে, আরও ২ কিলোমিটার এগিয়ে ডান হাতে খাড়া পাহাড়। শীতে এই পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং শেখানো হয়। এইখানে গাড়ির রাস্তা ছেড়ে উঠে গেছে ড্যামস্যাং জং-এ যাওয়ার কাচা রাস্তা। ‘জং’ ভুটিয়া শব্দ, যার মানে দুর্গ। জানা গেল, ফোর হুইল ড্রাইভওয়ালা গাড়ি নিয়ে এই পথে দুর্গ যাওয়া যায়। তবে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ বেশি। চার পাশের দৃশ্য চাখতে চাখতে যাওয়া যায়। এক কিলোমিটার হেঁটে চোখে পড়ল পাহাড় কেটে ইমারত তৈরির কাজ চলছে। বোর্ডিং হাউজ হবে। পর্যায়ক্রমে পাকা হবে রাস্তাও।
৭।

পথের দু’পাশে কোনও লোকালয় নেই। এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে চিলৌনি আর ধুপি গাছের জটলা। আরও এক-দেড় কিলোমিটার পরে দেখতে পেলাম চা বাগান। যেত্নর অভাবে অবশ্য সে বাগানের অিস্তত্ব লোপ পেতে বসেছে। শ্রাবণ জানাল, এক সময় সুগিন্ধ লিকারের জন্য এই উদ্যানের চায়ের খ্যাতি ছিল। তখন বিদেশের বাজারে রপ্তানি হত এই চা। চা বাগানের মালিক ছিলেন রাজ পরিবার। কালেস্রাতে ভেসে গেছে রাজেত্বর গরিমা আর তার ছাপ পড়েছে চা বাগান পরিচর্যার ক্ষেত্রেও।
৮।

চা বাগান ছেড়ে ঢুকে পড়লাম পাইনের জঙ্গলে। সুপ্রাচীন মহাদ্রুম রক্ষীরা আগলে রেখেছে দুর্গের প্রবেশপথ। তাদের ঘন ডালপালার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌছয় না। স্যাতস্যাতে ভেজা ভেজা আবহে একটানা ঝিঁঝির কোরাস বেজে চলেছে।
কোথাও গাছের পাতা থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে হিমের ফোটা নীচের পচা পাতার স্তূপে। পায়ের তলায় মখমলি ঘাসের ওপরে চলতে হচ্ছে খুব সাবধানে, কারণ সেখানে জোকের উপদ্রব। জঙ্গলের শেষে, পাহাড়ের মাথায় তার যাবতীয় ঐতিহাসিক নিঃসঙ্গতা নিয়ে দাড়িয়ে ড্যামস্যাং দুর্গ। সময় তার বলিষ্ঠতায় জরার প্রলেপ দিয়েছে।
চার পাশের ঘন জঙ্গলের ছায়া পড়ে জলের রং পান্না-সবুজ। সেই জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের দল। হ্রদ ঘিরে সুন্দর বাধানো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবার গোল চত্বর, মাথায় রঙিন ছাতা। লেকের জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। লেকের পূর্ব পাড়ে টিলার মাথায় ছবির মতো রিসর্ট। পশ্চিম পাড়ে শিবমিন্দর। অধিষ্ঠিত বিগ্রহ তান্ত্রিক বৌদ্ধরূপী মহাদেব। উত্তর পাড়ে খাড়া টিলাকে বেড় দিয়ে উঠেছে সিঁড়ির ধাপ। টিলার ওপরে ছাতা লাগানো কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট। সিঁড়ি ভাঙার ক্লান্তি দূর হয়ে যায় সেখানে বসে নীচের উপত্যকার মনোরম দৃশ্য দেখে। পাহাড়ের অন্য ঢালে ছড়িয়ে আছে আরিটার গ্রাম। ধাপচাষের ছোট খেত দেখলে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা’য় বর্ণিত শতরঞ্জ খেলার ছকের উপমা। একটু তফাতে এক টুকরো জমির ওপর হেলিপ্যাড। শুনলাম, সেনাবাহিনীর কপ্টার মাঝেমধ্যে সেখানে নামে। ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু বসতেই কঁাপুনি ধরাল। ঢুকে পড়লাম লেকের পাড়ের তিব্বতি গুমটিতে। পর্ক, মোমো আর তোংবা দিয়ে জমে গেল বিকেলের জলখাবার।
No comments:
Post a Comment